ভরা মৌসুমেও ইলিশের আকাল, জেলে পরিবারে ঈদের আনন্দ নেই
বরগুনা, ২৮ আগষ্ট (মনির হোসেন কামাল/আমাদের বরিশাল ডটকম): ‘ঈদ করমু কি দিয়া ? খাওনই জোডেনা। না খাইয়াই মরতে অইবে। কয়েকটা মাছ পাইলেই মহাজনরা দাদনের টাহার লইগ্যা আইয়া খাড়াইয়া থাহে। প্যাডে পাথর বান্দোন ছাড়া আর কোন উপায় নাই।’ একথাগুলো বললেন, পাথরঘাটার পদ্মা গ্রামের প্রান্তিক জেলে সদস্য মোস্তফা বয়াতি। একই কথা বললেন, পাথরঘাটা উপজেলার গাববাড়িয়া গ্রামের হারুন অর রশিদ, রুহিতা গ্রামের আলম গাজী ও আলমগীর হোসেন। তারা চারজনেই মহাজনের কাছ থেকে ১ লাখ টাকা করে দাদন নিয়েছেন। ২৭ আগষ্ট শনিবার রাতে তারা বঙ্গোপসাগর থেকে ইলিশ মাছ নিয়ে পাথরঘাটা মৎস্য বন্দরে এসেছিলেন।
মোস্তফা বয়াতি জানান, ২৫ হাজার টাকা খরচ করে বঙ্গোপসাগরে গিয়েছিলেন। মাত্র পনেরটি ইলিশ মাছ নিয়ে ফিরে এসেছেন। ইলিশগুলো ৬ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। মহাজন দাদনের টাকার অংশ হিসেবে ৫ হাজার টাকা রেখে দিয়েছেন। এক হাজার টাকা দিয়ে এখন তিনি কি করবেন ! একইসাথে ফিরে আসা জেলে হারুন অর রশিদ ২১টি, আলম গাজী ৪০টি ও আলমগীর হোসেন ৫০টি ইলিশ পেয়েছেন। ফিরে আসা সকল জেলেই জানান, একবার সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে ফিরে আসতে ২৫/৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। এবারে কারোই চালান ওঠেনি। তারা আরো জানান, বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে গিয়ে জলদস্যু আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। এখনো তাদের ৬৩ জন জেলেকে মুক্তিপণের দাবীতে আটকিয়ে রাখা হয়েছে।
ইলিশের ভরা মৌসুমেও বঙ্গোপসাগরে চলছে ইলিশের মহা আকাল। বার বার গভীর সাগরে নিস্ফল প্রচেষ্টার পরে ক্লান্ত-শ্রান্ত হাজার হাজার উপকূলীয় জেলেরা এখন হতাশ। সেই সাথে উপার্জনহীন এসব পরিবারে চলছে চরম অভাব। অনাহার-অর্ধাহারে তারা মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। বঙ্গোপসাগরে প্রায় সারা বছরই কম বেশী ইলিশ পরলেও মুলত: জুন মাস থেকেই ইলিশের ভরা মৌসুম ধরা হয়। আগস্ট মাসে বড় আকারের বেশী ইলিশ পড়ার কথা। এ সময় জেলে পাড়ায় ব্যস্ততা থাকার কথা। ইলিশের প্রাচুর্যে পুরো উপকূল জুড়ে থাকার কথা উৎসবের আমেজ। বছরের এই মৌসুমেই সাধারনত জেলেদের ঘরে ভাত থাকে, থাকে সচ্ছলতার আমেজ। ইলিশ বিক্রি করেই তারা ঋণ পরিশোধ করে। স্ত্রী-সন্তান-বাবা-মায়ের জন্য কাপড়সহ সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তারা এ সময়ই কিনে থাকে। মোট কথা হচ্ছে, জেলে পল্লীর জেলেরা এই মৌসুমের জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকেন। কিন্তু এবারে ঘটেছে উল্টোটা। ইলিশের ভরা মৌসুম ধরা হলেও এখন পর্যন্ত ইলিশের কোথাও দেখা নেই। ইলিশের মোকাম বলে খ্যাত বরগুনার পাথরঘাটার মৎস্য বন্দরের মৎস্য অবতরন ও পাইকারী বাজার কেন্দ্রে জেলে আড়ৎদার ও মহাজনদের কোন ব্যস্ততা নেই।
পাথরঘাটা মৎস্য অবতরন ও পাইকারী বাজার কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক লে. কমান্ডার হুমায়ূন কবির আমাদের বরিশাল ডটকমকে জানান, গত বছর জুন, জুলাই, আগস্ট মাসে যেখানে ৭/৮ কোটি টাকার ইলিশ বিক্রি হয়েছে। সেখানে এবছর এক কোটি টাকার ইলিশ মাছও বিক্রি করা যায়নি।
ইলিশের এ ভরা মৌসুমেও ইলিশের আকাল বিষয়ে বরগুনা জেলা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, প্রকৃত পক্ষেই ইলিশ প্রকৃতির দান, প্রকৃতিই জানে ইলিশ কখন বেশী পাওয়া যাবে। তার মতে এই মৌসুমেই ইলিশ বেশী পাওয়া যাবার কথা। তিনি আরো বলেন, তার বয়সে এককালীন এমন ইলিশের আকাল কখনো দেখেননি।
জেলা মৎস্যজীবি ট্রলার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবদুল মান্নান মাঝি জানান, বর্তমানে উপকূলের জেলেদের বড়ই দুর্দিন যাচ্ছে। একের পর এক নিম্নচাপের পূর্বাভাসের সঙ্গে সঙ্গে বৈরী আবহাওয়ার কারনে যেটুকু ইলিশ পড়ে, তাও তারা গভীর সাগরে গিয়ে আহরন করতে পারছেন না। পাশাপাশি তিনি উপকূলীয় জেলেদের শত বছরের সমস্যা জলদস্যুদের নিয়েও কথা বলেন। তার মতে জেলেদের নিরাপত্তায় সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেয়া দরকার। পাথরঘাটা মৎস্য বন্দর ছাড়াও কলাপাড়ার আলীপুর, মহিপুর, কুয়াকাটা, রাঙ্গাবালী, মৌডুবি, ফেলাবুনিয়ায় কয়েকশ ইলিশের আড়ৎ রয়েছে। সমুদ্রে ইলিশ মাছ ধরা না পরায় এ সকল আড়ৎগুলোও বর্তমানে কর্মব্যস্তহীন হয়ে পরেছে। গভীর সমুদ্রে ইলিশের সন্ধানে গিয়ে জেলেরা ফিরে আসছে শুন্য হাতে।
কুয়াকাটার আড়ৎদার রহিম শরীফ জানান, প্রতিবছর এরকম সময়ে তারা মাছ বিক্রি করে শত শত কোটি টাকা আয় করেছেন। কিন্তু এবারের চিত্র আলাদা।
রাঙ্গাবালী এলাকার বরফ ব্যবসায়ী লিমন জানান, মাছ না পরায় বরফ ব্যবসায়ও ধস নেমেছে। এদিকে ইলিশ সরবরাহ কম থাকায় ইলিশের দাম আকাশ ছোঁয়া। বরগুনার বাজারে প্রতি কেজি ইলিশ ৬ শত টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা জানান, এ অবস্থা চলতে থাকলে তাদের পথে বসা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা হরেন্দ্র নাথ সরকার জানান, বর্তমানে জেলেদের জালে ইলিশ ধরা না পরলেও ভবিষ্যতে পরবে বলে আশা করা যায়।
–
(আমাদের বরিশাল ডটকম/বরগুনা/মহো/তাপা)
সম্পাদনা: সেন্ট্রাল ডেস্ক |