পোস্ট-ই সেবা সেন্টারে সরকারি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র! এস এম মুন্না, নাজিরপুর
‘রানার ছুটেছে তাই ঝুম্ঝুম্ ঘন্টা বাজছে রাতে/ রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে।’ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য যুগের সেই রানার আজও আছে। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের এই দিনে তার ছোটাছুটির ব্যস্ততা ঝিমিয়ে পড়েছে। কুরিয়ার সার্ভিসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পোস্ট অফিস যখন হাঁফিয়ে উঠে লোকসান গুনছে, তখন একবিংশ শতকের উপযোগী করতে পোস্ট অফিসকে ই-পোস্ট অফিসে (ডিজিটাল) রুপান্তরিত করা হচ্ছে।
সরকার কয়েকটি প্রকল্পের মধ্যে ৫৪১ কোটি টাকা ব্যয়ে গ্রামীণ পোস্ট অফিসে ‘পোস্ট ই-সেন্টার ফর রুরাল কমিউনিটি’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। যেখানে গ্রাম পর্যায়ে ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তিগত সেবাসহ ডাক বিভাগের আর্থিক সেবা প্রদান করবে। কিন্তু পিরোজপুরের নাজিরপুরের পোস্ট অফিসগুলোতে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র।
তারা অন্যসব সেবা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পোস্ট ই-সেন্টারে সরকার নির্ধারিত সাইনবোর্ড থাকা সত্ত্বেও একটি মহল নিজেরা লাভবান হতে তরুণ প্রজন্মসহ জনসাধারণকে আকৃষ্ট করতে বিশালাকৃতির সাইনবোর্ডে লেখা হয়েছে ‘সরকারি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’!
যেখানে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনার জন্য নেই পর্যাপ্ত কম্পিউটার, নেই নির্ধারিত কোর্স কারিকুলাম, নেই পর্যাপ্ত জনবল ও অবকাঠামো, নেই প্রশিক্ষিত শিক্ষক, পরীক্ষা সংক্রান্ত কোন কথাই উল্লেখ নেই নীতিমালায়। তাছাড়া কোর্স সম্পন্ন শেষে সনদপত্র দিবে কোন শিক্ষা বোর্ড; জানা নেই তাও। তবুও এটা ‘সরকারি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র!’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার কলারদোয়ানিয়া ইউনিয়ন বিএনপি’র সভাপতি মাস্টার মোঃ আঃ হালিমের মেয়ে দিলারা ইয়াসমীন নাজিরপুর পোস্ট ই-সেন্টারের হার্ডওয়্যার টেকনিশিয়ান হিসেবে কর্মরত রয়েছে। কৃষি বিষয়ে ডিপ্লোমা পাশ করা দিলারা পারভীনের নির্দেশেই চলে এই পোস্ট ই-সেন্টার।
তার নির্দেশেই ব্যানার, সাইনবোর্ড ও অন্যান্য সকল প্রচারকাজে ‘সরকারি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ লেখা হয়েছে বলে জানান পোস্ট মাস্টার গোলাম মোস্তফা। তাছাড়া পোস্ট ই-সেন্টারের নীতিমালায় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ সেবার মূল্য মাত্র ৩ শ’ টাকা নির্ধারণ করা থাকলেও তারা প্রশিক্ষনার্থীদের নিকট ৩ হাজার টাকাও বেশী আদায় করছে বলে অভিযোগ ওঠেছে।
কতিপয় অদক্ষ ও মুনফালোভী কর্মকর্তার কারণে পোস্ট ই-সেন্টারের মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে এসে নীতিমালা লঙ্গন করে শুধুমাত্র নিজেরা লাভবান হওয়ার জন্য ‘সরকারি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ লিখেছেন বলে মনে করেন নাজিরপুর উপজেলা সদরে অবস্থিত বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড অনুমোদিত কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ‘ডায়মন্ড টেকনোলজি’র পরিচালক মনোজ মন্ডল।
তিনি আরো জানান, এসব অদক্ষ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কারণে আইসিটি’র প্রকৃত জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হওয়ার পথে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার আগামী প্রজন্ম। তাছাড়া এসব কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কারণেই ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হচ্ছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার ভিত্তিক এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য।
সরেজমিনে গত বৃহস্পতিবার নাজিরপুর উপজেলা পোস্ট ই-সেন্টারে যাওয়ার পথে উপজেলা টেম্পু স্ট্যান্ড সংলগ্ন রাস্তা জোড়া বিশালাকৃতির সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। সেখানে সরকারি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র উল্লেখ করে ‘জুন-ডিসেম্বর (৭মাস ব্যাপী) সেশনে’ ভর্তির বিজ্ঞাপন টানানো হয়েছে।
ভেতরে গিয়ে পোস্ট মাষ্টারের সাথে কথা বলতে গেলে এগিয়ে আসে পোস্ট ই-সেন্টারের হার্ডওয়্যার টেকনিশিয়ান দিলারা ইয়াসমীন। কৃষি বিষয়ে ডিপ্লোমা পাশ করা দিলারা ইয়াসমীন ওই অফিসের প্রধান বলে পরিচয় দেন। সেখানে একাউন্টিংয়ে অনার্স ২য় বর্ষে অধ্যায়নরত আঃ আহাদ নামে একজন উদ্যোক্তা রয়েছে।
সাইন বোর্ড, ব্যানারসহ অন্যান্য প্রচার কাজে ‘সরকারি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ লেখার বিষয়ে জানতে চাইলে তারা জানান, নীতিমালায় এমনভাবে লেখার অনুমতি নেই। তাছাড়া উর্ধ্বতন কোন কর্মকর্তার অনুমতি ছাড়াই তারা ব্যক্তিগতভাবে এটা করেছেন। তাদের ট্রেনিং রুমে প্রবেশ করে দেখা যায়, মাত্র ২ টি ডেস্কটপ ও ৩ টি ল্যাপটপ দিয়ে চলছে তাদের ট্রেনিং কার্যক্রম।
ট্রেনিং সেন্টারের জনবল সম্পর্কে জানতে চাইলে উদ্যোক্তা আহাদ জানায়, এখানে মানুষ অন্যকোন সেবা নিতে আসেন না বললেই চলে। তাই, তার অধীনে শুধুমাত্র কম্পিউটার ট্রেনিং কার্যক্রম চালানো হয়। এ সময় তাদের কোর্স কারিকুলাম, সিলেবাস, নীতিমালা সংক্রান্তে জানতে চাইলে তিনি গত মে মাসের ৪ তারিখে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ কর্তৃক ইস্যু করা একটি চিঠি দেখান।
চিঠিতে পূর্বে চালুকৃত ১৫ দিন, ৩০ দিন ও ৩ মাস মেয়াদী কোর্সের পাশাপাশি ৬ মাস মেয়াদী ‘ডিপ্লোমা ইন সফটওয়্যার এপ্লিকেশন’ কোর্স চালুর বিষয়ে পরিচালক মহোদয় সম্মতি প্রদান করেছেন। এসব কোর্সে অংশগ্রহণকৃত শিক্ষার্থীরা পোস্টাল একাডেমী রাজশাহীর নেতৃত্বে ৪ টি পোস্টাল ট্রেনিং সেন্টারে পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে কৃতকার্য শিক্ষার্থীদের মাঝে সনদপত্র বিতরণ করবে।
কিন্তু নাজিরপুরের শিক্ষার্থীরা কোথায় গিয়ে পরীক্ষায় অংশ নিবে তা জানেনা এখানের উদ্যোক্তা ও শিক্ষার্থীরা। তবে পোস্ট ই-সেন্টারের হার্ডওয়্যার টেকনিশিয়ান দিলারা ইয়াসমীন তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ডেপুটি পোস্ট মাস্টার জেনারেল (ডিপিএমজি) আব্দুল মালেকের নিকট ফোন করার পর সাংবাদিকদের জানান, শিক্ষার্থীদেরকে খুলনা বিভাগীয় শহরে পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সনদপত্র অর্জন করতে হবে।
এমন আরেকটি সরকারি কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারের খোঁজ পাওয়া গেছে উপজেলার গাওখালী বাজারে। এটায়ও জামায়াত বিএনপি সমর্থিত পার্শ্ববর্তী দীর্ঘা ইউনিয়নের লেবুজিলবুনিয়া গ্রামের আলী হোসেনের পুত্র সবুর হোসেন উদ্যোক্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সবুর হোসেন যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী স্থানীয় এমপি থাকাকালীন সময়ে তার আস্থাভাজন ছিলেন। এখন একটি কিন্ডার গার্টেন স্কুলে চাকুরি করার সুবাদে তিনি এলাকায় স্যার হিসেবে পরিচিত। কিন্ডার গার্টেনের এ শিক্ষক বেশ কয়েক বছর যাবত কম্পিউটার প্রশিক্ষণ সংক্রান্তে শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতারণা করে ধরা পড়ার পর নিত্য নতুন নামে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান তৈরী করে চলছেন।
জিমকো ডিজিটাল কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার, গাওখালী আইডিয়াল কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার, ঢাকা থেকে মডেল আইটি পরিচালিত আইডিয়াল কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারসহ নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠান করে শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতারণা করে আসছেন। একই ঘরে সর্বশেষ সরকারি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সাইনবোর্ড লাগিয়েছেন।
সরেজমিনে এ প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা যায়, একটি কাঠের ঝুপরি ঘরের মধ্যে চলছে এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। উপস্থিত এক শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদেরকে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সনদপত্র দেয়ার কথা বলে ভর্তি করা হয়েছে। সবুর স্যার পরিচালিত এ প্রতিষ্ঠানের বৈধতা নেই এবং তাদের ভর্তিকৃত কোর্সেরও অনুমোদন নেই জেনে ইতোমধ্যে তার এক সহপাঠি ভর্তি বাতিল করে এ প্রতিষ্ঠানের সামনে গ্রামীণ সুপার মার্কেটে অবস্থিত বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড অনুমোদিত একটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছে। ওই শিক্ষার্থীও ভর্তি বাতিল করার জন্য এসেছেন।
বিগত বছরে সবুর স্যার পরিচালিত প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষায় অংশ নেয়া এক ছাত্রী জানান, জিমকো ডিজিটাল কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদন রয়েছে বলে তাদেরকে ভর্তি করা হয়। কিন্তু চূড়ান্ত পরীক্ষার সময় জানতে পারে প্রায় ১শ’ কি.মি. দূরে ভান্ডারিয়া উপজেলার একটি প্রতিষ্ঠানের হয়ে তাদেরকে পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়েছে। পরীক্ষা শেষে তাকে গভীর রাতে বাড়িতে ফিরতে হয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে ডেপুটি পোস্ট মাস্টার জেনারেল (ডিপিএমজি) আব্দুল মালেকের নিকট জানতে ফোন করা হলে তিনি সাংবাদিকদের মুঠোফোনে কোন তথ্য দিতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে কথা হলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. তবিবুর রহমান বলেন, ‘পোস্ট ই-সেন্টার প্রকল্পে সরকরি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে প্রচারের বিষয়টি আমার জানা নেই।’
সম্পাদনা: বরি/প্রেস/মপ |