বাঁশির সুরে ৫৩ বছর পার বেতাগীর আমজাদের জাকির হোসেন, আমতলী
বাঁশির সুরে ৫৩ বছর পার করেছেন বরগুনার বেতাগী উপজেলার আমজাদ হোসেন হাওলাদার। শিশু বয়সে শখের বসে বাঁশি বাজিয়ে মানুষকে আনন্দ দিতে এসে এটা এখন তার পেশা আর নেশা হয়ে দাড়িয়েছে।
আমজাদের অস্থি মজ্জায় বাঁশি বাজানো ছাড়া এখন আর কিছুই নেই। শহর বন্দর গ্রাম গঞ্জে মন কারা বাঁশির সুর করে হাটছেন আর বাঁশি বিক্রি করছেন। অভাবী সংসার চলে বাঁশি বিক্রির টাকায়।
পরিবারের দারিদ্রতা দমাতে পারেনি আমজাদের বাঁশি বাজানো থেকে। মানুষে ভালোবাসা আর আনন্দ দিতে বাঁশের বাঁশিতে এখনো অবিরাম সুর তুলে চলছেন আমজাদ হোসেন।
বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলার কেওড়াবুনিয়া গ্রামের মৃত্যু মহব্বত আলীর ছেলে আমজাদ হোসেন। ১৯৫৫ সালে জন্মের পর ওই গ্রামে বেশী দিন থাকা হয়নি তার। ছোট বেলা থেকেই দুরন্ত পনা আর বাঁশের বাঁশি বাজানোর প্রতি অসম্ভব ঝোঁক ছিল তার।
তাই ৯ বছর বয়সের সময় ১৯৬৪ সালে পরিবারের কাউকে কিছু না বলে চলে যান ঝালকাঠির কৃত্তিপাশা গ্রামের বিখ্যাত বাঁশি বাদক ওস্তাদ আজিজ নট্টর কাছে। সেখানে ১২ বছর তার সানিধ্যে থেকে বাঁশিতে সুর তোলা শেখেন। সাথে সাথে তিনি ওস্তাদের সাথে তখন বিভিন্ন যাত্রাপালায়ও বাঁশি বাজাতেন।
এক সময় তিনি চলে আসেন বাড়িতে। বাড়ি এসে বসে থাকার পাত্র নয় আমজাদ হোসেন। বাঁশের বাঁশি হাতে মাঠ ঘাট গ্রাম থেকে গ্রামে বন জঙ্গল আর পৌষের গভীর রাতে সুরের ঝঙ্কার তুলে ছুটে বেড়াতেন এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। মানুষ তার বাঁশির সুর শুনে ছুটে আসতেন কাছে বিমোহিত হয়ে শুনতেন ছোট্ট এই ছেলের বাঁশিতে কি মধুর সুর।
এভাবে অবিরাম বাঁশি বাজানোর পর আমজাদের নাম ডাক ছড়িয়ে পড়ে বরগুনা জেলা সহ নানা যায়গায়। ডাক আসে বিভিন্ন যাত্রাপালায় বাাঁশি বাজানোর জন্য। একে একে বরগুনার চলন্তিকা অপেরা, সোনালী অপেরা, মোরেলগঞ্জের রাজশ্রী অপেরা ও মোংলার উদয়ন যাত্রা পালায় ১৫০ টাকা বেতনে বাঁশি বাজাতেন। কালের বিবর্তনে এসকল যাত্রদল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বেকার হয়ে পড়েন আমজাদ হোসেন।
তিন ছেলে মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে মহাবিপাকে পড়েন তিনি। কিভাবে সংসার চালাবেন আর সন্তানের মুখে দুটো ভাত তুলে দেবেন সে চিন্তায় অস্থির ছিলেন। শত প্রতিকূলতার মাঝেও হাত থেকে বাঁশি ছাড়েননি আমজাদ হোসেন। তাই সিদান্ত নিলেন বাঁশি বিক্রির। চট্টগ্রামের লালদীঘির পাড় এবং কুমিল্লার হোমনা থেকে বাঁশি সংগ্রহ করে কাঁধে তুলে নেন ব্যাগ ভর্তি বাঁশি।
সুর করে গ্রামে গ্রামে প্রথমে বাঁশি বিক্রি শুরু করেন। তাতে বেশী একটা আয় না হওয়ায় চলে যান শহরে। এভাবে ঢাকা, বরিশাল, আমতলী, পটুয়াখারী, বরগুনা, খুলনা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন শহরে বাঁশি বিক্রি করে এখন সংসার চালান আমজাদ হোসেন।
বুধবার দুপুরে তার সাথে কথা হয় আমতলী সদর রোডের সরকারী কলেজের গেটের সামনে।
তিনি জানালেন, ৬৫ সাল থেকে ৫২ বছর ধরে বাঁশিতে সুর তুলে মানুষকে মুগ্ধ করছি। বিনিময়ে বাঁশি বিক্রি করে দৈনিক ২ থেকে ৩শ’ টাকা পাই। যে সামন্য টাকা পাই তা আমার নিজের খরচেই চলে যায়। বাঁশি বিক্রির টাকা দিয়ে ৩ জনের সংসার চলে না। প্রতি মাসে ধার দেনা করে স্ত্রী ছেলের মুখে ভাত তুলে দিতে হয়।
তিনি বলেন, ছোট ছেলে জহিরুল ইসলাম বেতাগী সরকারী কলেজে বিএ লেখা পড়া করে তার পড়ার খরচ যোগার করতে পারি না। খরচের অভাবে লেখা পড়াও প্রায় বন্ধের পথে। এভাবে আর কত দিন সংসার চালব। বয়সের ভারে এখন আর বেশী ঘুরতে পারি না। আয় নাই ভবিষ্যতে কি করে সংসার চালব তা নিয়ে এখন দুশ্চিন্তায় আছি। তিনি আরো জানালেন গ্রামে যখন বাঁশি বাজাতাম তখন ‘মুজিব বাইয়া যাওরে’ গানটি বাঁশিতে সুর তোলামাত্র মুহুর্তের মধ্যেই শত শত লোক জমা হয়ে যেত। আমার তখন খুব ভাল লাগত। বঙ্গ বন্ধু প্রেমী এই আমজাদ হোসেন এখনো নিজের অজান্তে বাঁশিতে এই গানটির সুর তোলেন বলে জানালেন এ প্রতিবেদকে।
আমজাদ হোসেনের সম্পদ বলতে বেতাগী শহরের লঞ্ছঘাট এলাকায় ভাইদের সাথে যৌথ ভাবে ২ তিল বসত ঘরের যায়গা ছাড়া আর কিছুই নেই। জীবনের স্বীকৃতি বলতে ২০০২ সালে বরিশাল বেতারের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যোগ দেই। তবে সেখানে বছরে ২টি প্রোগ্রামে অংশ গ্রহন করা ছাড়া আর কোন কাজ নেই। তাতে ১ থেকে দেড় হাজার টাকা পান। এ দিয়ে আসা যাওয়া খরচও হয় না। তিনি নিজের স্বীকৃতিসহ শিল্পীদের সম্মানী বাড়ানোরও দাবী করেন।
এই গুণী শিল্পী আমজাদ হোসেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাঁশির সুর নিয়ে জীবন কাটাতে চান এ জন্য প্রয়োজন সরকারী সহযোগিতা। জীবন কাটাতে সরকরী সহযোগিতাই চাইলেন তিনি।
|