আমতলী-তালতলীতে ৮৯ কোটি টাকার রবি ফসলে ক্ষতি জাকির হোসেন, আমতলী
ফাইল ফটো
বরগুনার আমতলী ও তালতলী উপজেলায় ৫ দিনের অকাল ভারী বর্ষণে ক্ষেতে পানি জমে লক্ষাধিক ক্ষুদ্র, প্রান্তিক, মাঝারি ও বড় পর্যায়ের চাষীদের তরমুজ, বাদাম, মরিচ, ডালসহ সরকারী হিসেবে ২৫ হাজার ৯শ’ ১৫ হেক্টর জমির ৮৯ কোটি টাকার রবি ফসলের ক্ষতি হয়েছে বলে সরকারি ভাবে নির্ধারন করা হয়েছে ।
তবে বেসরকারী ভাবে ক্ষতির পরিমান আরো অনেক বেশী। বহু কষ্টে ক্ষেতের রবি ফসল হারিয়ে চাষীরা এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছে।
আমতলী ও তালতলী উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, দু’উপজেলায় এবছর চলতি রবি মৌসুমে ২৫ হাজার ৯ শ’ ১৫ হেক্টর জমিতে খেশারী, মুগ ডাল, তরমুজ, মরিচ, বাদাম, সূর্যমুখী, ভূট্টা. গোল আলু, মিষ্টি আলু, খিরাই ও শাকসবজি চাষ করে।
এর মধ্যে গত বুধবার থেকে রবিবার পর্যন্ত ৫ দিনের টানা ভারী বর্ষনে দুই উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের ৩২ হাজার চাষীর অধিকাংশ ক্ষেতে প্রায় ১ থেকে দেড় ফুট পানি জমে ফসল তলিয়ে যায়। এর মধ্যে সরকারী ভাবে দুই উপজেলায় ফসলের যে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা নিরুপন করেছে তার মধ্যে খেশারী ১০ হাজার হেক্টর, মুগ ডাল ৯হাজার ৮শ’ হেক্টর, তরমুজ ২ হাজার ৮শ’ ৫ হেক্টর, মরিচ ৫শ ৫০ হেক্টর, বাদাম ৫শ’ ২৫ হেক্টর,সুর্য্যমুখী ৪ শ’ ৫০ হেক্টর, ভূট্টা ১শ’ ৪০ হেক্টর,গোল আলু ১শ’ হেক্টর, মিষ্টি আলু ৫ শ’ ৯০ হেক্টর, খিরাই ১শ’ ৫৫ হেক্টর ও শাকসবজি ৮ শ’ ৫০ হেক্টর।
সরকারি ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের মূল্য ধরা হয়েছে ৮৯ কোটি টাকা তবে বেসরকারী ভাবে ক্ষতির পরিমান প্রায় ১শ’ কোটি টাকা।
দুই উপজেলার অনেক গ্রাম সরেজমিন ঘুরে এবং কথা বলে জানা গেছে , যে সময় আলু, মরিচ, বাদাম, তরমুজ ঘরে তোলার কথা সেময় আকস্মিক বৃষ্টিতে সকল ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকের স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। আমতলী উপজেলার, পাতাকাটা, টেপুরা, দক্ষিণ সোনাখালী, রাওঘাসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে এখনো অনেক যায়গায় ১ থেকে দেড় ফুট পানিতে ফসলের মাঠ তলিয়ে আছে। চাষীরা ফসল রক্ষর জন্য সেচ পাম্প বসিয়েও ফসল রক্ষা করতে পারেনি।
মধ্য সোনাখালী গ্রামের কৃষক নূর হোসেন কান্না জরিত কন্ঠে জানান, ধারদেনা কইরা প্রায় ৩ লাখ টাকা খরচ কইরা তরমুজ লাগাইছি হেই তরমুজ ক্ষেত পানিতে সব ভাইস্যা গেছে। এহন ধার দেনা দিমু কিকইরা আর পোলামাইয়া লইয়া খামু কি হেইচিন্তায় আছি।
মধ্য সোনাখালী গ্রামের আরেক চাষী নানির প্যাদা ওরফে হামজা জানান, এনজিও সংগ্রাম ও কোডেক থেকে ৩লাখ টাকা ঋণ নিয়ে এবং গ্রামের মহাজনের নিকট থেকে ১ লাখ টাকায় মাসে ২হাজার টাকা সুদে এনে ৪ লাখ টাকা খরচ করে ৮ একর জমিতে তরমুচ চাষ করছি। গত ৪ দিনের ভারী বৃষ্টিতে খ্যাত তলাইয়া যাওয়ায় আমার সব শ্যাষ হইয়া গেছে। ক্ষেতে তরমুজ পাব এখন সেই আশা ভরসা ছাইরা দিছি।
একই দশা পাতাকাটা গ্রামের দেলোয়ার হাওলাদারের। এনজিও থেকে ৬০ হাজার টাকা লোন নিয়ে ৩ একর জমিতে তরমুজ চাষ করেন। তার ফসলও এখন পানিতে ভাসছে।
টেপুরা গ্রামের রিপর প্যাদা ও কাঠালিয়া গ্রামে মজনু মোল্লা জানান, তরমুজ চাষ কউলা মোরা এবার পথের ফকির অইয়া যামু। বৃষ্টিতে খ্যাত নষ্ট হওয়ায় প্রায় ৫ লাখ টাকা লোকসান হবে।
তালতলী উপজেলার ভাইজোরা গ্রামের আক্কাস মৃধা জানান ২ লাখ টাকা খরচ করে ২৬ একর জমিতে সূর্য্যমুখী চাষ করেছি। গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে ক্ষেতে পানি জমে সকল সূর্য্যমুখীর গাছ বিবর্ন হয়ে গেছে। এতে আমার ২ লাখ টাকাই লোকশান হবে।
হলদিয়া গ্রামের মুগডাল চাষী শানু মোল্লা জানান, ১০ বিঘা জমিতে মুগ ডাল হালাইছি এহন ক্ষেতে পানি জইম্যা আছে। আলু মরিচের সব ক্ষ্যাত শেষ অইয়া গেছে। মোগো কোমর এহন ভাইঙ্গা গেছে।
টেপুরা গ্রামের রিপন মাতুব্বর জানান, এবছর ১৫ একর জমিতে প্রায় ৩ লাখ টাহা খরচ কইরা তরমুজ লাগাইছি। পানিতে তলাইয়া সব গাছ এহন শুকাইয়া গেছে। আসল টাহাও ঘরে আনতে পারমু না।
দক্ষিণ তক্তাবুনিয়া গ্রামের কৃষক আমিন উদ্দিন জানান, অপরিকল্পিত ভাবে সুবান্দি বাধ ও ছোট ছোট খাল দখল করে বাঁধ দিয়ে মাচ চাষ করায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাষনের কোন ব্যবস্থা না থাকায় জলাবদ্ধতায় রবি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
বেসরকারী সংস্থা সংগঠিত গ্রামো উন্নয়ন (সংগ্রাম) এর এরিয়া ম্যানেজার মো: ফয়সাল হোসেন জানান, এবছর আমতলী উপজেলায় তরমুজ ৩ শ’ ৫০ জন কৃষককে দেড় কোটি টাকার উপরে ঋণ দিয়েছে। তরমুজ ক্ষেত নষ্ট হলে আমাদের ঋণের টাকা আদায় করা খুব কষ্টকর হবে।
আমতলী ও তালতলী দুই উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা এসএম বদরুল আলম জানান, বুধবার থেকে আজ রবিবার পর্যন্ত ৫ দিনের টানা ভারী বর্ষণে ক্ষেতে পানি জমে আমতলী ও তালতলী উপজেলায় ২৫ হাজার ৯শ’ ১৫ হেক্টর জমির ডাল, বাদাম, মরিচ, তরমুজ, কললা, শাকসবজি ও আলুসহ রবি ফসল ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে সরকারি ভাবে ক্ষতির পরিপান ৮৯ কোটি ২৩ লাখ ৯শ’ ১৬ টাকা নির্ধারন করে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠানো হয়েছে।
তালতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) তৌছিফ আহম্মেদ জানান, ৫ দিনের বৃষ্টিতে রবি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষকরা যাতে বাঁচতে পারে সেজন্য কৃষি বিভাগের মাধ্যমে ক্ষক্ষতি নির্ধারন করে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠানো হয়েছে।
আমতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: মুশফিকুর রহমান জানান, গত ৫ দিনে টানা ভারী বর্ষণে কৃষকের রবি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। উপজেলঅ কুষি অফিস সরকারী ভাবে আমতলীতে প্রায় ৪৮ কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারন করে জেলা প্রশাসকের নিকট পাঠানো হয়েছে।
সম্পাদনা: বরি/প্রেস/মপ |