ঝালকাঠি জেলার কাঠালিয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের বিষখালী নদীতে এক যুগেরও আগে ৭০ একর জমি নিয়ে নদীর বুকে জেগে উঠে এক বিশাল চর। যেখানে রয়েছে লক্ষাধিক ছৈলা গাছ। আর ছৈলা গাছের নাম থেকেই জেগে ওঠা এ চরের নামকরণ করা হয়েছে ছৈলার ছৈলা ছাড়াও এখানে কেয়া, হোগল, রানা, এলি, মাদার, আরগুজিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছে ঘেরা। ছৈলা গাছের ডালে ডালে শালিক, ডাহুক আর বকের ঝাঁক। গাছে গাছে রয়েছে মৌমাছির বাসা ও মৌচাক। তাই পাখির কিচিরমিচির ডাক ও মৌমাছির গুন গুন শব্দ সব সময় শোনা যায়। শীতের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে অভয়াশ্রম হিসেবে আশ্রয় নিতে আসতে শুরু করেছে অতিথি পাখিও। ভ্রমণ পিপাসুদের প্রতিদিনের পদচারণায় এখন মুখরিত ছৈলার চর।
কাঠালিয়া লঞ্চঘাট থেকে নৌপথে যেতে হয় ছৈলার চরে। ২০১৫ সালে ঝালকাঠি জেলা প্রশাসন ছৈলারচর স্থানটি পর্যটন স্পট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তবে বাস্তবায়ন হয়নি ৬ বছরেও। এত সব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা সত্তে¡ও ছৈলার চরে রয়েছে নানা সমস্যা। এখানে সড়ক পথে যাতায়াতে নেই কোন ব্যবস্থা। সিঁড়ি না থাকায় নৌ পথের পর্যটকদের ছৈলার চরে যেতে হচ্ছে হাঁটু সমান পানি ও কাদা ভেঙে। নেই বিশুদ্ধ পানি ও শৌচাগারের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। চরের মধ্যে হাঁটার জন্য কোন রাস্তা নেই। বিশ্রামের জন্য কোন বিশ্রামাগার না থাকায় অনেক পর্যটক সেখানে যেতে বিমুখ হচ্ছে। পর্যটকদের জন্য কোন নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই। পর্যটন এলাকাকে ঘিরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও রেস্ট হাউজ করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞদের মতে, ছৈলা একটি লবণ সহিষ্ণু বন্য প্রজাতির বৃক্ষ। উপক‚লীয় নদী তীরবর্তী চর, জোয়ার ভাটার প্রবহমান খালের চর ও প্লাবনভূমি জুড়ে কোন যতœ ছাড়াই প্রকৃতিগতভাবে জন্ম নেয় এবং বংশ বৃদ্ধি হয় এ বৃক্ষের। ছৈলা গাছের শেকড় মাটির অনেক গভীর অবধি যায় তাই সহসা ঝড় ও জলোচ্ছাসে ভেঙে কিংবা উপড়ে পড়ে না। ফলে উপকূূলীয় এলাকায় প্রকৃতিবান্ধব গাছ হিসেবে ছৈলা বনবিভাগের সংরক্ষিত বৃক্ষ। কেবল কাঠের মূল্য বিবেচনায় নয়; মাটির সুদৃঢ় গঠনে পর্যায়ক্রমিক একটি দরকারি বৃক্ষ প্রজাতি হিসেবে ছৈলা গাছকে বিবেচনা করা হয়। তাই দুর্যোগ প্রবণ উপকূূূলে প্রকৃতিবান্ধব ছৈলা গাছ কাটা নিষেধ। কাঠালিয়ার উদীয়মান নারী সংগঠক ও কলেজ ছাত্রী সাদিয়া জাহান মনি বলেন, পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়তে হলে নদীর পাড় থেকে একটি ঘাটলা, সড়ক পথে যোগাযোগের জন্য কিল্লার পাড় থেকে একটি সেতু, উন্নত মানের বেশ কিছু টয়লেটের ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যকর পানীয় জলের ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত গেস্ট হাউজ, নিরাপত্তার জন্য প্রহরীর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশাসনিকভাবে এটি বাস্তবায়ন হলে অবকাঠামো ও পর্যটন সুবিধা পেলে সরকার এখান থেকে রাজস্ব পাবে। দি হাঙ্গার প্রজেক্ট বরিশাল বিভাগীয় কো-অর্ডিনেটর এবং কাঠালিয়ার সমাজ কর্মী মো. ফারুক হোসেন খান বলেন, উপক‚লীয় জেলা ঝালকাঠির দক্ষিণ জনপদ কাঠালিয়ার বিষখালী নদীর তীরে প্রাকৃতিক ভাবে জেগে ওঠা নয়াভিরাম ‘ছৈলার চর’ পর্যটন খাতের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও রয়েছে নানা সংকট। প্রতিক‚ল যাতায়াত ব্যবস্থা ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাবে পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় এ স্থানে পর্যটকরা চিন্তিত থাকেন। তবু সেই সংকট উপেক্ষা করেই প্রকৃতির নয়নাভিরাম এই ছৈলার চর পর্যটকদের মিলনমেলায় পরিণত হচ্ছে। শুকনো মৌসূম এলেই পর্যটকের ভিড় থাকে ছৈলার চরে। বিভিন্ন সরকারী-বেসকারী প্রতিষ্ঠান, স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা এবং বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে স্বপরিবারে পিকনিকে আসে প্রকৃতির সাথে পরিচিত হতে। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি পাবে বিষখালীর তীরে জেগে ওঠা ছৈলার চর।
ব্যবসায়ী শামসুল হক মনু জানান, শীত এলেই এসব জলাশয়, নদীর তীরের নিরাপদ স্থানসহ বিভিন্ন হাওর, বাঁওড়, বিল ও পুকুরের পাড়ে চোখে পড়ে নানা রং-বেরংয়ের নাম জানা, অজানা পাখির। অথচ বেআইনিভাবে শিকার হচ্ছে এসব পাখি। অতিথি পাখি আমাদের বন্ধু, আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের গর্ব, আমাদের প্রেরণা। আবাসিক ও অতিথি পাখি মিলে আমাদের দেশে পাখির প্রায় ৬৫০ প্রজাতির। এর মধ্যে ৩৬০ প্রজাতি আবাসিক। বাকি ৩০০ প্রজাতি অতিথি পাখি। সব অতিথি পাখি শীতের সময় আসে না। ৩০০ প্রজাতির মধ্যে ২৯০টি শীত মৌসুমে আসে ও ১০টি প্রজাতি থেকে যায়। এ পাখি গুলোকে অচেনা পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে আমাদের বন্ধুসুলভ আচরণ করা দরকার। এই পাখিগুলো রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। ঝালকাঠি সরকারী কলেজের প্রাণি বিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোসাম্মাৎ জেবুন্নেছা জানান, প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে পাখির একটা অতুলনীয় মিল রয়েছে। যে কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পূর্বেই পাখি তা টের পায়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতিথি পাখির আগমন পূর্বের চেয়ে অনেকটাই কমে গেছে। এছাড়াও স্থানীয় মানুষদের শৌখিনতা আ পেশাদার শিকারের ফলে অবাধ বিচরণ করতে না পারায় দিনদিন ক্রমান্বয়ে অতিথি পাখির আগম হ্রাস পাচ্ছে। উত্তরাঞ্চলে শীতের তীব্রতা বেড়ে গেলে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে নিরাপদ স্থানের গন্তব্যে ছুটে চলে। অনেক সময় পাখির ঝাক ক্লান্তি বোধ করলে নদীর বাঁকে বা কোন জলাশয়ে বিশ্রাম ও খাবারের খোজে নেমে পড়ে। সেখানে নিরাপদ আশ্রয় স্থান মনে করলে পাখি সেখানেই আশ্রয় নেয়। আশ্রয়স্থল অনিরাপদ বা বিঘ্নিত মনে করলে আবার সেখান থেকে ঝাক বেধে উড়াল দেয়। অতিথি পাখিরা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বেই প্রতিবছর ভ্রমণ করছে। প্রতিবছরই তারা শীতপ্রধান অঞ্চলের তীব্র শীত থেকে বাঁচতে উড়ে যাচ্ছে হাজার হাজার মাইল দূরের অপেক্ষাকৃত কোনো উষ্ণ অঞ্চলের দিকে। সাদা চোখে কিছু না বোঝা গেলেও পাখিদের এই ভ্রমণের একটা আন্তর্জাতিক গুরুত্ব আছে বলেও জানান প্রাণিবিদ্যাবিদ মোসাম্মাৎ জেবুন্নেছা।
ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যটন কর্পোরেশনকে ছৈলার চরকে পর্যটন স্পট তালিকাভুক্তির জন্য চিঠি দিয়ে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়েছে। তালিকাভুক্তি হলেই পর্যটকদের চাহিদা অনুযায়ী ব্যবস্থা তারাই করবেন। জরুরি ভিত্তিতে উপজেলা প্রশাসনকে বলেছি সাধ্যমত ব্যবস্থা করতে।
সম্পাদনা: আমাদের বরিশাল ডেস্ক
প্রকাশক: মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন তালুকদার সম্পাদক: মো: জিয়াউল হক
সাঁজের মায়া (২য় তলা), হযরত কালুশাহ সড়ক, বরিশাল-৮২০০।
ফোন : ০৪৩১-৬৪৫৪৪, মুঠেফোন : ০১৮২৮১৫২০৮০ ই-মেইল : hello@amaderbarisal.com
আমাদের বরিশাল ডটকম -এ প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।