অবৈধ করাতকলে চোরাই গাছ: বনাঞ্চল উজার মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া
উপকূলীয় কলাপাড়ায় লাইসেন্স ছাড়াই চলছে অন্তত ৩০টি করাতকল। অবৈধ এসব করাতকলে সংরক্ষিত বনাঞ্চলসহ উপকূলীয় বাঁধ বাগান, সামাজিক বনায়নের গাছ অহরহ চুরি করে চেরাই হচ্ছে। ফলে উপকূলীয় বনাঞ্চল নিধন হয়ে যাচ্ছে।
সরোজমিনে অনুসন্ধানে জানাগেছে, ১০ বছরে এসব করাতকলের কারণে বেড়িবাঁধের বাইরের মাইলের পর মাইল বনাঞ্চল উজাড় হয়ে গেছে। সংরক্ষিত বাগানও এখন বিরানভূমিতে পরিণত হচ্ছে। এমনকি কুয়াকাটায় জাতীয় উদ্যানের আশপাশ এলাকায় বসানো হয়েছে করাতকল।
অভিযোগ রয়েছে, বনবিভাগের সংশ্লিষ্ট রেঞ্জের কর্মকর্তা, বিট কর্মকর্তা ও ফরেস্টগার্ডদের প্রত্যক্ষ যোগসাজশে বছরের পর বছর এসব করাতকল চালু রয়েছে। বনাঞ্চলসহ পরিবেশ রক্ষার্থে উপজেলা বন ও পরিবেশ কমিটি রয়েছে। কিন্তু এ কমিটির কার্যক্রম চলছে কাগজে কলমে।
বহুবার সভাচলাকালে অবৈধ করাতকল বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু কোন পদক্ষেপ নেয়া হয় নি। এমনকি পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকায় সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।
জানাগেছে, সরকারি নিয়ম অনুসারে পৌর এলাকা ব্যতীত সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে এর ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে কোন ধরনের করাতকল স্থাপন করা যাবে না। কিন্তু এসব নিয়মের তোয়াক্কা না করেই যে যার মতো বনবিভাগের সংশ্লিষ্ট বিট ও রেঞ্জকর্তাদের ম্যানেজ করে করাতকল স্থাপন করেছে। চলছে কাঠ চেরাইয়ের কাজ।
লালুয়ার চর নিশান বাড়িয়া এলাকার মহিলা ইউনিয়ন পরিষেদের (ইউপি) সদস্য রাবেয়া বেগম জানান- শিশুগাছ, ছইলা, কেওড়া গাছ দেদার কেটে আশপাশের করাতকলে চেরাই করা হয়। তাদের বেড়িবাঁধের বন উজার করে দেয়া হয়েছে। এতে বেড়িবাঁধটি চরম ঝুকিপুর্ণ হয়ে আছে।
ইউপি সদস্য নাসির তালুকদার একই ক্ষোভ ব্যক্ত করলেন। একই দৃশ্য কলাপাড়া উপজেলার সক ক’টি ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের স্লোপের। হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। রাতের বেলা কেটেই সংলগ্ন করাতকলে চেরাই করে বিক্রি করা হয়। আবার এসব গাছ বিভিন্ন ইটভাটায় পাচার করা হয়।
অনুসন্ধানে জানাগেছে, লতাচাপলী ইউনিয়নের লক্ষ্মীর পোলের দুইদিকে দু’টি করাতকল রয়েছে। অথচ এখান থেকে গঙ্গামতি ও ধুলাসার সংরক্ষিত বনাঞ্চলের দুরত্ব মাত্র দুই কিলোমিটার। এভাবেই নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করেই করাত কল বসানো হয়েছে। চলছে গাছ চেরাইয়ের উৎসব।
ইউপি চেয়ারম্যানদের দেয়া তথ্যমতে, চাকামইয়ায় একটি, টিয়াখালীতে একটি, লালুয়ায় চারটি, মিঠাগঞ্জে তিনটি, নীলগঞ্জে পাঁচটি, মহিপুরে পাঁচটি, লতাচাপলীতে পাঁচটি, ধানখালীতে সাতটি, বালিয়াতলীতে আটটি, ডালবুগঞ্জে দুইটি এবং চম্পাপুর ইউনিয়নে পাঁচটি করাত কল রয়েছে। এছাড়া কলাপাড়া পৌর শহরে রয়েছে ১৩ টি করাতকল রয়েছে।
বনবিভাগ কলাপাড়ার তথ্যমতে কলাপাড়া উপজেলার ১২টি ইউনিয়নসহ পৌরসভায় মোট করাতকল রয়েছে ৫৯টি। যার দুই তৃতীয়াংশ অবৈধ। স্থানীয় বন কর্মকর্তার দাবি প্রায় ৪০টির লাইসেন্স আছে। তবে এর সঙ্গে বাস্তবের কোন মিল নেই। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের সনদ আছে কাদের তা নিশ্চিত করতে পারেন নি। কয়েক বছর আগে মহিপুর এলাকার কয়েকটি করাতকলের মালিককে নোটিশ করা হয়েছিল। ওই পর্যন্তই শেষ।
বনবিভাগের মহিপুর রেঞ্জের কর্মকর্তা এমদাদুল হক জানান- তার অধীনে কতগুলো করাতকল রয়েছে এর হিসাব তার কাছে আপাতত নেই। এ বছরের মার্চ মাসেও তিনি একই কথা বলেছেন। সংশ্লিষ্ট বিট কর্মকর্তাদের করাতকলের তালিকা হালনাগাদ করার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান।
স্থানীয় বন পরিবেশ কমিটির সদস্য সৈয়দ হাবিবুর রহমান টিকলু জানান- এ সংক্রান্ত সঠিক কোন তথ্য উপজেলা পর্যায়ের সভায় জানানো হয় না। মিটিং হয় শুধুমাত্র কাগজে-কলমে।
বরিশাল পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক সুকুমার বিশ্বাস জানান- প্রত্যেকটি করাতকলের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র থাকতে হবে। এছাড়া প্রতিবছর এর নবায়ন করতে হবে। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হচ্ছে।
সম্পাদনা: বরি/প্রেস/মপ |