![]() বেশি দামের ইলিশ কম দামে রপ্তানি
২২ September ২০২৫ Monday ১২:২১:২৩ PM
স্থানীয় বাজারে প্রতি কেজি ১৯০০-২০০০ টাকা, রপ্তানি হচ্ছে ১৫২৫ টাকা দরেবিশেষ প্রতিনিধি: ![]() দেশের মানুষের কাছে ইলিশ যেন সোনার হরিণ। দাম চওড়া হওয়ায় সাধারণ মানুষের পক্ষে ইলিশ খাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে দেশের বাইরে রপ্তানির ক্ষেত্রে ঘটছে উলটোটা। বেশি দামের ইলিশ ভারতে রপ্তানি হচ্ছে কম দামে। এ নিয়ে দেশজুড়ে চলছে তোলপাড়। বাংলাদেশে যেখানে ইলিশের বাজারদর প্রতি কেজি ১৯০০-২০০০ টাকা, সেখানে রপ্তানি হচ্ছে ১৫২৫ টাকা দরে। কিন্তু কীভাবে। এ প্রশ্ন সবার। বেশি দামের ইলিশ কম দামে রপ্তানির রহস্য কী-এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা যায়, ইলিশের গন্তব্য শুধু ভারতেই নয়; সেখান (ভারত) থেকে তা পুনঃরপ্তানি হয়ে যাচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশে। ভারতকে ট্রানজিট হিসাবে ব্যবহার করে তৃতীয় দেশগুলোতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ইলিশ। এর পেছনেও রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তাদের নিয়ন্ত্রণে চলছে এই ব্যবসা। এ সিন্ডিকেটে রয়েছেন দুই দেশের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। শুধু বছরে একবার রপ্তানির সুযোগেই নয়, বরং সারা বছরই চলে এই ইলিশ পাচার। সে ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় সীমান্তে চোরাচালানের নানা রুট। দামের তারতম্য : ২০০৭ সাল থেকে বন্ধ বিদেশে ইলিশ রপ্তানি। দাম নিয়ন্ত্রণ ও দেশে ইলিশ সহজলভ্য করতে এই সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ। দেড় যুগ ধরে রপ্তানি বন্ধ থাকলেও ব্যতিক্রম ভারত। প্রতিবছর পূজায় ভারতে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেয় সরকার। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামেই হতো রপ্তানি। তবে সেই দাম ছিল দেশের বাজারের চেয়ে কম। এবারও ঘটেছে একই ঘটনা। চলতি বছর ১২০০ টন ইলিশ ভারতে রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। এতে দাম ধরা হয় কেজিপ্রতি সাড়ে ১২ ডলার বা ১ হাজার ৫২৫ টাকা। ৮ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ের ওই নির্দেশ জারির পর দেখা দেয় নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। কেননা দেশের বাজারে তখন এলসি সাইজ (রপ্তানিযোগ্য ইলিশ স্থানীয়ভাবে এলসি সাইজ নামে পরিচিত। যার ওজন প্রতি পিস ৭শ থেকে ৯শ গ্রাম) ইলিশের কেজি ১৫৫০ টাকা। এর সঙ্গে বরফ, পলিথিন, প্যাকিং ও পরিবহণসহ আরও খরচ রয়েছে। এই হিসাবে ১৫০০ টাকা দরে কিনলেও ভারত পর্যন্ত পৌঁছাতে খরচ পড়বে প্রায় ১৭০০ টাকা। তাহলে কিভাবে ১৫২৫ টাকা দরে ইলিশ রপ্তানি করবেন ব্যবসায়ীরা? এ নিয়ে লেখালেখি হলেও সরকার দাম বাড়ায়নি, তেমনি রহস্যজন কারণে রপ্তানিকারকরাও দর বাড়ানোর কোনো আবেদন করেননি। উপরন্তু অনুমতি পাওয়ার পর রপ্তানি শুরু করে দেন ৩৭ রপ্তানিকারক। রপ্তানি শুরুর প্রথম ৩ দিনে আখাউড়া আর বেনাপোল স্থলবন্দর হয়ে ভারত গেছে প্রায় ৭০ টন ইলিশ। এদিকে দেশে আরও বেড়েছে ইলিশের দাম। রোববার বরিশাল মোকামে এলসি সাইজের ইলিশ প্রতি কেজি ১৯০০ টাকা দরে সংগ্রহ করছেন পাইকাররা। মোকামের ব্যবসায়ী গোপাল চন্দ্র সাহা জানান, ‘রপ্তানির উদ্দেশ্যে ৮-১০ জন বরিশাল মোকাম থেকে কিনছেন ইলিশ। ১৮৫০-১৯০০ টাকা দরেই কিনছেন তারা। তিনি বলেন, যতদূর জানি, খুলনা ও বরিশালের দুই রপ্তানিকারকের প্রতিনিধি এরা। অবাক লাগে, তারা ১৯০০ টাকা কেজি কিনে কিভাবে ১ হাজার ৫২৫ টাকা দরে রপ্তানি করছেন।’ প্রথমে ভাবা হয়েছিল কম দামে রপ্তানি হলেও ভারতের আমদানিকারকদের কাছ থেকে হয়তো গোপনে বেশি দাম নিচ্ছেন তারা। হুন্ডি অথবা অন্য কোনো অবৈধ মাধ্যমে বাকি টাকা আসছে দেশে। কিন্তু বাংলার ইলিশ ভারতে যে দামে বিক্রি হচ্ছে, তাতে সেই সম্ভাবনাও নেই। কলকাতার হাওড়া-পাতিপুকুর বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ১৫০০-১৬০০ রুপি দরে। মুদ্রামানে যা ২১০০-২২০০। যেখানে ভারতে পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতি কেজি ইলিশে খরচ দাঁড়ায় ২১০০ টাকা। সেখানে ভারতে এই দামে তা বিক্রি অসম্ভব। কিভাবে এই অসম্ভবকে সম্ভব করা হচ্ছে-তা খুঁজতে গিয়েই বেরিয়ে আসে ভারত হয়ে তৃতীয় দেশগুলোতে ইলিশ কাহিনি। ভারতকে ট্রানজিট করে বাংলাদেশের ইলিশ পাচার : মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের প্রবাসী বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা বুকিত বিনতাং। সেখানকার বাংলাদেশি খাবার হোটেলগুলোতে প্রায় সারা বছরই মেলে পদ্মার ইলিশ। ইলিশ মাছের টুকরো বিক্রি হয় ২৫-৩০ রিঙ্গিত দরে। বাংলাদেশি টাকায় সাড়ে ৭০০-৯০০ টাকা। যে দেশে বাংলাদেশ থেকে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ, সেখানে কিভাবে ইলিশ পাচ্ছেন-এমন প্রশ্নে পরিচয় না প্রকাশের শর্তে কুয়ালালামপুরের এক হোটেল ব্যবসায়ী বলেন, ইলিশ তো সরাসরি বাংলাদেশ থেকে আসে না। আমরা পাই ভারত থেকে। ফ্রোজেন হয়ে সেখান থেকে আসে পদ্মার ইলিশ। রপ্তানি হয় ভারতীয় লাইসেন্সে। তবে চুক্তিটা হয় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। ভারতীয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে এখানে ইলিশ পাঠান তারা।’ একই তথ্য মিলল সিঙ্গাপুরের মোস্তফা এলাকার একাধিক বাঙালি হোটেল ব্যবসায়ীর কাছ থেকে। তাদের কাছেও বাংলাদেশের ইলিশ যায় ভারত হয়ে। সিঙ্গাপুর প্রবাসী বরিশালের বাসিন্দা ইলিয়াস সরদার বলেন, এখানে ৫০-৬০ ডলার রেটে বাংলাদেশের কেজি সাইজের ইলিশ কিনি আমরা। বাংলা টাকায় যা ৬-৭ হাজার। কলকাতার হাওড়া বাজারের একাধিক মাছ ব্যবসায়ী বলেন, এটা তো চলছে বহু বছর। পূজার সময় বছরে একবার এখানে ইলিশ পাঠায় বাংলাদেশ। এর বাইরে সারা বছর চোরাই পথে আসে বাংলাদেশের ইলিশ। যার ৮০ ভাগ আবার এখান থেকে রপ্তানি হয় অন্যান্য দেশে। বিদেশের ক্রেতাও ঠিক করেন বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা। দর-দাম ভেঙে তারাই পাঠান ইলিশ। মাঝখানে ব্যবহার হয় ভারতীয় রপ্তানিকারকদের লাইসেন্স। এ কারণেই তো বাংলাদেশ থেকে বেশি দামে কিনে ভারতে আনলেও লোকসান হয় না তাদের। ভারতে বাড়ি-ব্যবসা বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের : ভারত হয়ে তৃতীয় দেশে বাংলাদেশি ইলিশ পাচারের এই কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট। যে সিন্ডিকেটে রয়েছেন দুই দেশের ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ থেকে যেসব রপ্তানিকারক ভারতে ইলিশ রপ্তানি করেন তাদের অনেকেরই কলকাতায় রয়েছে নিজস্ব বাড়ি। হাওড়া-পাতিপুকুরসহ কলকাতার মাছের বাজারগুলোতে আড়ত, গদি রয়েছে অনেকের। ৪টি লাইসেন্সে ভারতে ইলিশ রপ্তানি করছেন বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক নীরব হোসেন টুটুল। ৫ আগস্টের পর ভারতে অবস্থান করেই তিনি চালাচ্ছেন বাংলাদেশের ব্যবসা। এবছরও টুটুলের ৪টি লাইসেন্স পেয়েছে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি। কলকাতার বশিরহাট এলাকায় শ্বশুরবাড়ি টুটুলের। সেখানে তার নিজেরও আছে বাড়িসহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। কলকাতায় বাংলাদেশের ইলিশ ব্যবসার অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন টুটুল। আরেক রপ্তানিকারক পাবনার সেভেন স্টার। ভারতের হাওড়ায় এই সেভেন স্টার কোম্পানির মালিকের রয়েছে মাছের গদি। সেখানে ফ্ল্যাটসহ নানা স্থাপনা রয়েছে তার। একইভাবে কলকাতার বারাসাতে বাড়িসহ মাছ বাজারে আড়ত আছে কেবিসি নামে আরেক রপ্তানিকারকের। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত একাধিক সংবাদকর্মী ও হাওড়া-পাতিপুকুর এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জানা গেছে, ভারতের ইলিশ বাজারে প্রচণ্ড প্রভাবশালী বাংলাদেশের এসব রপ্তানিকারক। পশ্চিমবঙ্গের মাছ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে এদের দারুণ সখ্য। পুরো বিষয়টি চলে এই দুপক্ষের সমঝোতায়। ওইসব নেতার সাহায্যে ভারতীয় আত্মীয়স্বজনদের নামে করিয়ে নিয়েছেন রপ্তানির লাইসেন্স। সেসব লাইসেন্সেই বাংলাদেশের ইলিশ পুনরায় তৃতীয় দেশে পাঠান তারা। এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলে মুখ খুলতে রাজি হননি রপ্তানিকারকদের কেউ। ভারতের ‘ফিশ ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন’র সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আনোয়ার মকসুদও স্বীকার করেননি কিছুই। ভারতকে ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে ইলিশ রপ্তানি প্রসঙ্গে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে আসা ইলিশ তো আমরাই গ্রহণ করি। তারপর ছড়িয়ে দেওয়া হয় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে। এখানে রি-এক্সপোর্টের কোনো বিষয় নেই।’ বাংলাদেশ ফিশ এক্সপোর্টার্স অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নিজামউদ্দিন বলেন, ‘দেশের চেয়ে কম দামে ইলিশ রপ্তানি কি করে সম্ভব? এ বিষয়ে কথা বলতে তানিসা এন্টারপ্রাইজের মালিক নীরব হোসেন টুটুলের ফোনে যোগাযোগ করেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি। কেবিসি ও সেভেন স্টার মালিকদের ফোন দেওয়া হলেও তারা রিসিভ করেননি। সম্পাদনা: আমাদের বরিশাল ডেস্ক প্রকাশক: মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন তালুকদার সম্পাদক: মো: জিয়াউল হক
সাঁজের মায়া (২য় তলা), হযরত কালুশাহ সড়ক, বরিশাল-৮২০০।
ফোন : ০৪৩১-৬৪৫৪৪, মুঠেফোন : ০১৮২৮১৫২০৮০ ই-মেইল : hello@amaderbarisal.com
আমাদের বরিশাল ডটকম -এ প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। |
||