মডেল সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নি হত্যা মামলা থেকে খালাসের পর দীর্ঘ ২৩ বছরের প্রবাস জীবনের ইতি টেনে দেশে ফেরার ঘোষণা দেন নব্বইয়ের দশকের আলোচিত-সমালোচিত ছাত্রনেতা গোলাম ফারুক অভি। গত নভেম্বরে কানাডা থেকে দেশে ফেরার কথা গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন সাবেক এই সংসদ সদস্য (এমপি)। তবে তার বাংলাদেশি পাসপোর্টের মেয়াদ বহু আগেই উত্তীর্ণ হওয়ায় দেশে ফিরতে হলে দরকার ট্রাভেল পারমিট। সেই ট্রাভেল পারমিটের জন্য দূতাবাসের মাধ্যমে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করলেও, তা ইস্যু না করে এক মাস ধরে আবেদনটি ইচ্ছা করে ফেলে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচনী এলাকা উজিরপুর-বানারীপাড়ার সমর্থক-অনুসারীদের ভাষ্য, অভিকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে দূরে রাখতেই ট্র্যাভেল পারমিট ইস্যুতে জটিলতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। অনুসারীদের এমন অভিযোগ গোলাম ফারুক অভি নিজেও উড়িয়ে দিচ্ছেন না। তবে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, অভির আবেদনের বিষয়টি তাদের জানা নেই।
গোলাম ফারুক অভি জানিয়েছেন, দেশে ফিরতে গত ১৪ নভেম্বর কানাডা থেকে ট্র্যাভেল পারমিট চেয়ে দূতাবাসের মাধ্যমে ঢাকায় একটি আবেদন পাঠান তিনি। নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সেই ট্র্যাভেল পারমিট ইস্যু হওয়ার কথা। কিন্তু আবেদনের পর কেটে গেছে ২৬ দিন। এখনো ট্র্যাভেল পারমিট পাননি। এমন পরিস্থিতিতে তার ট্র্যাভেল পারমিট পাওয়া নিয়ে যেমন একদিকে সংশয় দেখা দিয়েছে, তেমনি একই সঙ্গে আগামী নির্বাচনের আগে অভির দেশে ফেরাও অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ নিয়ে অভির নির্বাচনী এলাকা উজিরপুর-বানারীপাড়ায় তার সমর্থক-অনুসারীদের মধ্যে হতাশার পাশাপাশি বাড়ছে ক্ষোভ। অনেকে অভিযোগ করেছেন, অভিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতেই ট্র্যাভেল পারমিট ইস্যুতে জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছে। অনুসারীদের এমন অভিযোগ গোলাম ফারুক অভি নিজেও উড়িয়ে দিচ্ছেন না।
উজিরপুর উপজেলার ধামুরা এলাকার সন্তান গোলাম ফারুক অভি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ছিলেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। দেশের রাজনীতির ময়দানে নানা বাঁকবদলের তৎকালীন সময়ের নানান ঘটনায় আলোচিত-সমালোচিত অভি সপ্তম জাতীয় সংসদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন। ১৯৯৬ সালে বিএনপি চেয়ারপারসনের বর্তমান উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জম হোসেন আলালকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। তখন উজিরপুর-বাবুগঞ্জ উপজেলা মিলে ছিল বরিশাল-২ আসন। সে সময় জেপির মনোনীত প্রার্থী হয়ে ওই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন অভি। নির্বাচিত হয়ে নির্বাচনী এলাকায় বিস্তর উন্নয়নের মাধ্যমে নতুন করে আলোচনায় আসেন।
পরে বাবুগঞ্জ উপজেলা মুলাদীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে বরিশাল-৩ এবং উজিরপুরের সঙ্গে বানারীপাড়া যুক্ত হয়ে বরিশাল-২ নির্বাচনী এলাকা পুনর্গঠিত হয়। এরপর ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হেরে যান অভি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর একাধিক মামলায় জড়িয়ে ২০০২ সালে দেশ ছাড়তে হয় তাকে। এরপর টানা ২৩ বছর থেকে যান কানাডায়।
২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে দেশে ফেরার উদ্যোগ নেন গোলাম ফারুক অভি। এ নিয়ে আলোচনার রব ওঠে গোটা উজিরপুর এবং বানারীপাড়া উপজেলাজুড়ে। দেশে ফিরে বিএনপির মনোনয়নে বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে তিনি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে গুঞ্জন ওঠে। তবে আসনটিতে এরই মধ্যে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সারফুদ্দিন আহমেদ সান্টু। যে কারণে বিএনপির হয়ে অভির নির্বাচনে অংশগ্রহণের আপাতত আর সুযোগ দেখা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবেন বলে এলাকায় জোর আলোচনা রয়েছে।
নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে কিছু না বললেও গত নভেম্বরেই দেশে ফিরবেন বলে মোবাইল ফোনে এই প্রতিবেদককে জানিয়েছিলেন গোলাম ফারুক অভি। দেশে ফেরার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ট্র্যাভেল পারমিটের জন্য আবেদনও করেছিলেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আটকে আছে তার ট্র্যাভেল পারমিটের আবেদন।
জানা গেছে, গত ৬ নভেম্বর অটোয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসে ট্রাভেল পারমিটের জন্য টেলিফোনে যোগাযোগ করেন গোলাম ফারুক অভি। কিন্তু তাদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাননি। পরে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেন। পাশাপাশি গত ১৪ নভেম্বর নির্ধারিত ফরম পূরণ করে দূতাবাসে ট্র্যাভেল পারমিটের জন্য আবেদন পাঠান অভি। পরে দূতাবাস থেকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বরাবর ট্র্যাভেল পারমিট চেয়ে একটি আবেদন পাঠাতে বলা হয় তাকে। নির্ধারিত ফরমে সেই আবেদনটিও পাঠিয়েছেন তিনি। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণে দেশে ফিরতে চান বলে ওই আবেদনপত্রে উল্লেখ করেন অভি। স্বাভাবিক নিয়মে ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে নিজ দেশের নাগরিকদের দেশে ফেরার জন্য ট্র্যাভেল পারমিট দেওয়ার নিয়ম থাকলেও অভির ক্ষেত্রে এরই মধ্যে কেটে গেছে ২৬ দিন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গোলাম ফারুক অভি মোবাইল ফোনে বলেন, ‘দেশা ফেরাটাই এখন আমার মূল লক্ষ্য। আগে আমি দেশে ফিরি, তারপর নির্বাচনের বিষয়টি ভাবব।’
অভি অভিযোগ করে আরও বলেন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন তার করা ট্র্যাভেল পারমিটের আবেদনের ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত না দেওয়ায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উত্তর আমেরিকা ডেস্ক কানাডার বাংলাদেশ দূতাবাসকে এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দিতে পারছে না। সে কারণে দীর্ঘ ২৩ বছর পর তার দেশে ফেরা নিয়ে নতুন করে দেখা দিয়েছে সংশয়।
তবে এ প্রসঙ্গে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেছেন, বিষয়টি তাদের জানা নেই।
অভি জানিয়েছেন, তার নামে ইস্যু করা বাংলাদেশি পাসপোর্টের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছিল ২০০৬ সালে। বেশ কয়েকবার আবেদন করার পরও বাংলাদেশ দূতাবাস তার পাসপোর্ট নবায়ন করেনি। এ নিয়ে ২০১০ সালে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করেন অভির আইনজীবী। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ৪ এপ্রিল হাইকোর্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অভিকে দেশে ফেরার জন্য ট্র্যাভেল পারমিট ইস্যু করার নির্দেশ দেন। পরবর্তী সময়ে একই বছরের ১ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ নির্দেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠালেও দূতাবাস ট্র্যাভেল পারমিট ইস্যু করেনি বলে অভিযোগ অভির।
গোলাম ফারুক অভি বলেন, ‘আমি দেশে ফিরতে চাই—এটাই আমার মূল লক্ষ্য। নির্বাচন বা রাজনীতির বিষয়টি আমার কাছে মুখ্য বিষয় নয়। দেশে ফেরার জন্য একজন নাগরিকের ট্র্যাভেল পারমিট পাওয়া সাংবিধানিক অধিকার। এ অধিকার থেকে আমাকে বঞ্চিত করতে কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পাপেট বানাতে চাচ্ছে, তা নিশ্চয়ই আমার জানার বাইরে নয়।’
নব্বইয়ের দশকের আলোচিত ছাত্রনেতা গোলাম ফারুক অভির বিরুদ্ধে মডেল সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নি হত্যাসহ রাজনৈতিক একাধিক আলোচিত মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি ছিল। গ্রেপ্তার এড়াতে দেশ ছেড়ে টানা দুই যুগ ধরে অবস্থান করেন কানাডায়। শুধু তার মা দেশে থাকলেও বসবাস করেন ঢাকায়। এ কারণে উজিরপুরে অভিদের বাড়িটি অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে।
দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি মডেল তিন্নি হত্যা মামলা থেকে খালাস পান অভি। এরপরই তার দেশে ফেরার খবর চাউর হয়। তিনি আসছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নে, কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোটের মাঠে লড়বেন বলেও গুঞ্জন ছড়ায়।
আমাদের বরিশাল ডটকম -এ প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
(মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। amaderbarisal.com-এর সম্পাদকীয় অবস্থানের সঙ্গে এসব অভিমতের মিল আছেই এমন হবার কোনো কারণ নেই। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে amaderbarisal.com কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না।)