Current Bangladesh Time
Tuesday January ২১, ২০২৫ ১:০৮ AM
Barisal News
Latest News
১৩ April ২০২৪ Saturday ৯:৩১:০০ PM
Print this E-mail this

রেডিয়াম কন্যা।


নেবুলা মোর্শেদ:

সময়টা বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ।বাজারে তখন আভিজাত্য এবং শৌখিনতার প্রতীক হয়ে এসেছিল এমন কিছু ঘড়ি, যেগুলোর নাম্বার এবং কাটা অন্ধকারে জ্বলজ্বল করতো। অন্ধকারেও এই ঘড়ির সময় দেখা যেত।

ঘড়িগুলোর এমন উজ্জ্বলতার পিছনে ছিল এক বিশেষ ধরনের রং,যার কারনে এই ঘড়িগুলোর কাঁটা এবং নাম্বারগুলো অন্ধকারে জ্বলতো। 

১৯১৭থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত মার্কিন রেডিয়াম কর্পোরেশন মূলত রেডিয়াম লুইমিনাস মেটিরিয়াল কর্পোরেশন নামে পরিচিত ছিল,এই কোম্পানি কার্নোটাইট আকরিক থেকে রেডিয়াম নিষ্কাশন এবং পরিশোধন করে উজ্জল রং তৈরী করতো।

এই ধরনের ঘড়ি প্রস্তুতকারী প্রথম কারখানা স্থাপিত হয় ১৯১৭ সালে,নিউ জার্সির অরেঞ্জে। মাত্র ৭০ জন নারী কর্মচারী দিয়ে শুরু হওয়া নিউ জার্সির এই কারখানার শ্রমিক পরবর্তীতে কয়েক হাজারে পরিণত হয়।

👉 কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিক।

ঘড়ির নাম্বার এবং কাটায় একটি বিশেষ রং ব্যবহার করা হতো যার ফলে এগুলি জ্বলজ্বল করতো,আর তা হলো রেডিয়াম নামক একটি ভয়াবহ তেজষ্ক্রিয় (যে সকল মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা ৮২(82)-এর বেশী, সাধারণত সেই সকল পরমাণু তেজষ্ক্রিয় হয়) পদার্থ। রেডিয়ামের (Ra) এটমিক নাম্বার ৮৮। 

যেটি কিছু বছর (১৮৯৮)আগেই নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী মেরি কুরি আবিষ্কার করেছিলেন।

👉 মেরী কুরি।

মজার ব্যাপার হল,যখন রেডিয়াম প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল,এটি আসলে স্বাস্থ্যকর বলে মনে করা হয়েছিল।

অন্ধকারে জ্বলা এই ঘড়িগুলোর ডায়াল এবং কাটা রং করার কাজটি ছিল বেশ সূক্ষ্ম। রেডিয়াম মিশ্রিত রং তুলিতে মেখে সেই তুলির মাথা ঠোঁট দিয়ে সুচালো করে নিতে হতো, আর এই কাজটি প্রতিবার করতে হতো।

👉 রেডিয়াম মিশ্রিত রং তুলিতে মেখে সেই তুলির মাথা ঠোঁট দিয়ে সুচালো করে নিচ্ছে।

কিন্তু তারা কেউ বুঝতে পারেনি যে প্রতিটি তুলির আচরে তারা একটু একটু করে তেজষ্ক্রিয় পদার্থ রেডিয়াম শরীরে গ্রহন করেছিলো।এখন প্রশ্ন আসতে পারে কেন তারা এই কাজ করতে গেলো?

আসলে এখানে রেডিয়াম কন্যাদের (এদেরকে এই নামে ডাকা হতো) দোষ নেই কারন তারা এই কাজ করার আগে কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চেয়েছিলেন রেডিয়াম ক্ষতিকারক কিনা,কারখানা কর্তৃপক্ষ সেই আশঙ্কার কথা উড়িয়ে দেয়।কারখানায় কাজ করা মহিলাদের আশ্বস্ত করা হয়েছিলো যে রেডিয়াম পেইন্ট পুরোপুরি নিরাপদ।

👉 ঘড়ির ডায়ালে রং করছে।

কর্মরত নারীরা চাইলে এর নমুনাও সাথে করে নিয়ে যেতে পারে। এরপর থেকে নারীরা তাদের হাত পায়ের নখে এই রেডিয়াম মিশ্রিত রং লাগাতো এমনকি মেকাপ হিসাবে মুখেও ব্যবহার করতো,ফলাফল অন্ধকারে তাদের চেহারা এবং হাত পায়ের নখ থেকে আলোর দ্যুতি বের হতো। আর তারাও নিশ্চিন্ত মনে এই কাজ করতে থাকে।

👉 রেডিয়াম মিশ্রিত রং।

এছাড়াও ততদিনে অন্ধকারে জ্বলা এই ঘড়িগুলো বাজারে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠে। রেডিয়াম কন্যারা মনে করতেন সেই সময়ের সবচেয়ে মূল্যবান পদার্থ নিয়ে তারা কাজ করে। আর তাদের বেতন ছিলো অনেক বেশী,সমাজে রেডিয়াম কন্যাদের শিল্পীর মর্যাদা দেওয়া হতো। 

স্বভাবতই অর্থ,সামজিক মর্যাদা এবং সম্মানের জন্য দলে দলে নারীরা এই পেশায় যোগ দেন।

এর বাইরে রেডিয়াম উন্মাদনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সমাজের সর্বত্র।নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী  টুথপেস্ট, প্রসাধনী, মাখন,দুধ এমনকি খাবার এবং পানীয়তেও ব্যবহার করা হয় রেডিয়াম। 

এই রকম একটি পানীয়র নাম রেডিথর যা মূলত ডিস্টিলড ওয়াটার এবং রেডিয়ামের মিশ্রণ ছাড়া আর কিছুই না।

👉 রেডিথর।

সেই সময়ে রেডিয়াম ব্যবহার এত সাধারণ ছিল যে প্রধান কারণগুলির মধ্যে একটি হল যে এটি সঠিক এবং খুবই নিরাপদ। সেই সময় মানুষ জানতো যে,রেডিয়াম থেকে শক্তি বিকিরিত হয়। সে কারণে তারা নিজেদের শরীরে বাড়তি শক্তি যোগ করার মধ্যে কোনো দোষ খুঁজে পায়নি।

রেডিয়াম মিশ্রিত এই সব জিনিসের জনপ্রিয়তা যখন আকাশ ছোয়া ঠিক তখনি রেডিয়াম তার মরন ছোবল বসায়। 

কারখানার মালিক পক্ষ এই ব্যবসাটা এমন একটি লাভজনক পর্যায়ে নিয়ে যায় যে তারা রেডিয়ামের সব বিপদ লক্ষন উপেক্ষা করে। আর এর ফলাফল যন্ত্রনাময় মৃত্যু।

২০ এর দশকের শুরুর দিকে রেডিয়াম কন্যাদের অনেকের মাঝে রেডিয়ামের তেজষ্ক্রিয় বিষক্রিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে।

যেমন দাঁতে ব্যথা,গাল লাল বর্ন ধারন করা অবসাদ ইত্যাদি। ১৯২২ সালে কারখানার শ্রমিক মলি ম্যাগিয়া অসুস্থ হয়ে কারখানা ছেড়ে চলে যান। তার দাতে কালশিটে দাগ পড়া এবং সেই সাথে ব্যাথা।

👉 রেডিয়ামের বিষক্রিয়া।

মলি দাতের ডাক্তার দেখান এবং ডাক্তার তার আক্রান্ত দাত তুলে ফেলেন। অবশ্য তাতে কোন লাভ হয়নি বরং পাশের দাতও একই ভাবে আক্রান্ত হয়। তুলে ফেলা দাতের স্থানটি গাঢ় রং ধারন করে এবং সেখান থেকে অনবরত রক্ত এবং পূঁজ বের হতে থাকে।

সেইসাথে শুরু হয় শ্বাসকস্ট, এবং হাড়ের সংযোগ স্থলে প্রচন্ড ব্যাথা তার হাটাচলা বন্ধ হয়ে যায়।

ডাক্তারের মতে এটা হলো বাতরোগ সে তখন মলিকে অ্যাসপিরিন খেতে দেয়। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি অল্প সময়ের ভিতরে মলি তার সব দাত হারিয়ে ফেলে এবং তার মুখের ভিতরে সেই সাথে নিচের চোয়ালে সাড়া রহস্যময় সংক্রমণ ছড়িয়ে পরে।

শরীরের বিভিন্ন স্থানের গ্রন্থি ফুলে উঠে। এবং একপর্যায়ে তার নিচের চোয়াল খুলে আসে। ১৯২২ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর বিকাল  ৫ টায় ২৪ বছর বয়সে মলি মারা যায়। 

👉 রেডিয়ামের বিষক্রিয়া হাটুর ক্যান্সার। 

মৃত্যুর কারণ হিসেবে তার ডাক্তাররা সিফিলিসের কথা বলে। শুধু মলি একা নয় একের পর মলির অন্য সহকর্মীরা শীঘ্রই তাকে অনুসরণ করে।

ইউএসআরসি এই সব মহিলা কর্মীদের মৃত্যুর দায়ভার প্রায় দুই বছর ধরে তারা অস্বীকার করে। এবং ১৯২৪ সালে একটি কমিশন ঘটন করা হয় এই মৃত্যু কারন খতিয়ে দেখার জন্য। এদিকে কারখানার কতৃপক্ষ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেন এই বিষয়ের উপরে কাজ করার জন্য।

এবং বিশেষজ্ঞরা যখন রেডিয়াম এবং মহিলাদের অসুস্থতার মধ্যে সংযোগ নিশ্চিত করেছিলেন তখন কারখানার সভাপতি রাগ করেছিলেন। 

ফলাফল গ্রহণের পরিবর্তে,তিনি নতুন গবেষণার জন্য আরো অর্থ প্রদান করেছিলে। তিনি আরো বলেন যে এই সব মহিলারা চিকিৎসা জন্য কিছু

আর্থিক সুবিধা পাওয়ার জন্য এরা মিথ্যার আশ্র‍য় নিয়েছে।

মহিলা কর্মীরা তার এই কথায় আপত্তি করেন। এবং তাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় তাদের রহস্যময় অসুস্থতা এবং রেডিয়ামের মধ্যে কি সংযোগ আছে তা প্রমাণ করার। 

আর এরমধ্যেই রেডিয়াম কারখানার প্রথম পুরুষ কর্মচারী মারা যান। এরপরেই বিশেষজ্ঞরা এর জন্য কারখানাকে অভিযুক্ত করেন।

১৯২৫ সালে গ্রেস ফ্রেইয়ার নামের নিউজার্সির সেই প্রথম রেডিয়াম ঘড়ি কোম্পানির একজন কর্মচারী কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। 

👉 গ্রেস ফ্রেইয়ার।

কিন্তু গ্রেস এই মামলা লড়াই করার জন্য দুই বছর কোন আইনজীবী পাননি। অবশেষে ১৯২৭ সালে রেমন্ড বেরি নামের একজন আইনজীবী তাকে  সহায়তা করতে এগিয়ে আসেন।

গ্রেস তার চার সহকর্মীকে নিয়ে এই জটিল আইনি লড়াইয়ে অবর্তীন হন। নিউ জার্সি রেডিয়াম কন্যার-মামলা খবর পৃথিবীর সব সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সেই সাথে মানুষ জানতে পারে রেডিয়ামের ভয়াবহতার কথা।

👉 সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া খবর।

এর মধ্যেই রেডিয়াম ডায়াল পেইন্টের উদ্ভাবক ডঃসাবিন এ ভন সোকাকি ১৯২৮ সালের নভেম্বরে মারা যান,তিনি তার হাতে লাগা  রেডিয়াম থেকে অসুস্থ হয়েছিলেন,মুখ থেকে নয়। 

এই মৃত্যুটি মামলায় অনেক সাহায্য করে। ১৯২৮ সালে রেডিয়াম কন্যাদের পক্ষে রায় দেয় আদালত,জিতে যান রেডিয়াম কন্যারা। রেডিয়াম কোম্পানিগুলোও আপিলের আবেদন করতে থাকে।

👉 আক্রান্ত নারীর জবানবন্দী গ্রহন।

কিন্তু ১৯৩৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট আপিলের সর্বশেষ আবেদনটি খারিজ করে। 

আদালত রেডিয়ামের তেজষ্ক্রিয়তায় বেঁচে যাওয়াদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করে। রেডিয়াম যুক্ত খাদ্য এবং পানীয় বাজারে নিষিদ্ধ করা হয়। ধীরে ধীরে রেডিয়াম রঙের ব্যবহার উঠে যেতে থাকে এবং ১৯৬৮ সালের পর তা ঘড়িতে ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়।

কতজন রেডিয়াম তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হয়েছিলো তার সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি কারন অনেকের ক্ষেত্রে তেজষ্ক্রিয়তার লক্ষণ দেখা গেছে বেশ কয়েক বছর পর। তবে ধারণা করা হয়,তাদের সংখ্যা কয়েক হাজারেরও বেশি।

দি রেডিয়াম গার্লস বইয়ের লেখক কেটমুর বলেন রেডিয়াম কন্যাদের অনেকেই পঞ্চাশের দশকে বৈজ্ঞানিক গবেষণা এমনকি বিভিন্ন পরীক্ষার বিষয় হতে রাজি হয়েছিলেন। 

আজ মানবদেহের ভেতর তেজষ্ক্রিয়তার প্রভাব সম্পর্কে আমরা যা জানি তার জন্য আমরা রেডিয়াম কন্যাদের  কাছে ঋণী।রেডিয়াম কন্যাদের ত্যাগের অবদান ভোগ করে চলছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।

এই সব রেডিয়াম কন্যাদের কারনেই আজকাল,অধিকাংশ লোক জানে যে রেডিয়াম ভয়ঙ্কর ক্ষতিকারক,এবং এর বিকিরণ আপনাকে হত্যা করতে পারে। 

পিয়ের কুরি একবার বলেছিলেন যে তিনি এক কিলো বিশুদ্ধ রেডিয়াম নিয়ে ঘরে থাকতে চাইবেন না কারণ তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে এটি তার শরীরের সমস্ত ত্বক পুড়িয়ে দেবে,তার দৃষ্টিশক্তি ধ্বংস করবে এবং “সম্ভবত তাকে হত্যা করবে।” 

Source, Image: Buzz Feed, CNN Style, Good Reads, Ranker, Telegraph, Radio Side America.


শেয়ার করতে ক্লিক করুন:

আমাদের বরিশাল ডটকম -এ প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
(মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। amaderbarisal.com-এর সম্পাদকীয় অবস্থানের সঙ্গে এসব অভিমতের মিল আছেই এমন হবার কোনো কারণ নেই। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে amaderbarisal.com কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না।)
ফেসবুক চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত ৩১ জুলাই
বিকেল ৩টা থেকে চালু হচ্ছে মোবাইল ইন্টারনেট
বরিশালে কর্মকর্তাদের দাপ্তরিক কর্মকাণ্ডে তথ্য প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার শীর্ষক কর্মশালা অনুষ্ঠিত
রেডিয়াম কন্যা।
বাইসাইকেলকে মোটরসাইকেলে রুপান্তর করে চমক দেখালেন বৃদ্ধ রাজ্জাক
স্মার্ট অ্যাপে দুই ঘণ্টা পর পর জানা যাবে ভোট পড়ল কত
ধেয়ে আসছে ভয়াল সৌরঝড়, অকেজো হয়ে যেতে পারে জিপিএস-ইন্টারনেট সেবা
Recent: Mayor Hiron Barisal
Recent: Barisal B M College
Recent: Tender Terror
Kuakata News

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
আমাদের বরিশাল ২০০৬-২০২০

প্রকাশক ও নির্বাহী সম্পাদক: মোয়াজ্জেম হোসেন চুন্নু, সম্পাদক: রাহাত খান
৪৬১ আগরপুর রোড (নীচ তলা), বরিশাল-৮২০০।
ফোন : ০৪৩১-৬৪৫৪৪, ই-মেইল: hello@amaderbarisal.com