বরিশালের মাটি ছুঁয়ে তির তির করে বয়ে গেছে যে নদী সে নদীর নাম ধানসিড়ি। ধান সিড়ি নদী যে কবির হৃদয় ছুঁয়ে গেছে সে কবি জীবনানন্দ। যে কবির কবিতা পাঠক হৃদয় ছুঁয়েছে তাঁর নাম কবি জীবনানন্দ দাস।
কবি জীবনানন্দ দাসকে নিয়ে গর্ব বরিশালের। গর্ব বাংলা সাহিত্যের। কবি জীবনানন্দ দাসকে নিয়ে গবেষণা হচ্ছে প্রচুর। অতীতেও হয়েছে। বোধ করি রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের পর যাকে নিয়ে বেশী গবেষণা হচ্ছে তিনি কবি জীবনানন্দ দাস। গবেষণা নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের বিষয় বৈচিত্রই প্রমাণ করে কবি জীবনানন্দ দাসের কাব্য প্রতিভার।
আমাদের দেশে কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের জীবদ্দশায় তেমন একটা মূল্যায়ন হয় না। তারই ধারাবাহিকতায় জীবনানন্দ ব্যতিক্রম নন। তাঁর অকাল মৃত্যু অনেকের চোখ ঘুরিয়েছে তাঁর সাহিত্য কর্মের প্রতি। রবীন্দ্র সাহিত্য বলয় থেকে বেড়িয়ে এসে যারা কবিতায় নতুন স্বতন্ত্র ধারার সৃষ্টি করেছেন নিঃসন্দেহে বলা যায় কবি জীবনানন্দ দাশ তার মধ্যে অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব।
আধুনিক বাংলা কবিতার পথিকৃত, রেনেসার কবি, রোমান্টিক কবি-প্রকৃতির কবিযে বিশেষণে বিশেষায়িত করা হোক না কেন জীবনানন্দ বাঙলার কবি বাঙালীর কবি। আধুনিক বাংলা কবিতার জন্য আমাদেরকে তাঁর দারস্থ হতে হয়।
প্রিয় পাঠক, জীবনানন্দের কাব্য প্রতিভা কিংবা জীবনানন্দ দাশের ব্যক্তি জীবন নিয়ে অনেক আলোচনা ইতোমধ্যে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় হয়েছে। যে বিষয়টির অবতারণা করতে চাই তা হচ্ছে এই বরিশালে, জীবনানন্দের বরিশালে কবির স্মৃতি সংরক্ষণে আমরা কতটুকু যতœবান। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই সরকারি বেসরকারি কোন ভাবেই এই বরিশালে তেমন কেউ বা কোন প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসেনি কবি জীবনানন্দ দাসের স্মৃতি সংরক্ষণার্থে। জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র নজরুল জন্ম জয়ন্তী পালন সহ প্রতিথ যশা কবি সাহিত্যিকদের মৃত্যুবার্ষিকী পালনের একটি সরকারি উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে। কবি জীবনানন্দ দাসের বরিশালে তাঁর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী বলতে গেলে নীরবেই চলে যায়।
১৯৯২ সালে গড়ে ওঠা (বেসরকারি উদ্যোগে) ‘জীবনানন্দ একাডেমী’ বলতে গেলে প্রায় নিস্প্রভ। দু’একটি সাহিত্য সাংষ্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগ দায় সাড়ার মতো। আর স্মৃতি সংরক্ষণ? সেতো সোনার হরিণ।
জীবনানন্দ দাস বগুড়া রোডের যে বাড়িতে বসবাস করতেন সেই ‘সবানন্দ ভবন’ এখন হাত ঘুরে মালিকানা বদলে অন্যের দখলে। বর্তমান মালিক অতীত ইতিহাস স্মৃতি বিস্মৃত নন বলেই, ‘সর্বানন্দ ভবন’ এর পরিবর্তে বাড়ির নামকরণ করেছেন ‘ধানসিড়ি’। ধানসিড়ি’র খ্যাতি নিয়ে আজও ‘সর্বানন্দ ভবন’ পর্যটক জীবনানন্দ অনুরাগীদের মনে আনন্দের সঞ্চার করছে।
ধানসিড়ি’কে ঘিরেই আজও জীবনানন্দ অনুরাগীরা মটির সোদা গন্ধ পান। হয়তো বা শুননতে পান কিশোরীর নূপূর বিককন।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এই বাংলাদেশে প্রতিথ যশা কবি সাহিত্যিকদের পৈতৃক ভিটে বাড়ি কিংবা তাদের কোন স্মৃতি বিজরিত কোন ঐতিহাসিক স্থানের সংরক্ষণ-পরিচর্যা তেমন একটা হচ্ছে না বললেই চলে। তারপরও কিছু কিছু সম্মিলিত উদ্যোগ প্রশংসার দাবিদার। ফরিদপুরে পল্লীকবি জসিম উদ্দীনের স্মৃতি সংরক্ষণার্থে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে হয়।
মধু মেলার আয়োজন দিন দিন মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হচ্ছে। যশোরে কপোতাক্ষ নদ খ্যাত সাগরদাঁড়ি গ্রাম দাড়িয়ে আছে কালের নীরন সাক্ষী হয়ে।
কপোতাক্ষ নদের কল কল শব্দে কবি মাইকেল মধুসুদন দত্তের অনুসারী অনুরাগীরা খঁজে পান মধু কবিকে।
কপোতাক্ষ নদে অবগাহন করে নয় ভক্তকুল নদীতীরে বয়ে যাওয়া মৃদু মন্দ বাতাশে শরীর জুড়ান। বেসরকারি উদ্যোগে মধু কবির স্মৃতি সংরক্ষণার্থে গড়ে উঠেছে একটি মিউজিয়াম। পরিসরে বড় না হলেও উদ্যোগটি মহৎ। সরকারি উদ্যোগে গড়া একটি ডাকবাংলো ও পাঠাগার মধু কবির প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। কবি মাইকেল মধুসুদন দত্তের একটি অবক্ষ মুর্তি নতুন প্রজন্মকে চিনতে শেখায়, জানার জন্যে আগ্রহী করে তোলে। প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে মধু মেলার আযোজন এতদঞ্চলের সবচাইতে বড় অনুষ্ঠান। এলাকাবাসী অধীর আগ্রহে উন্মুখ হয়ে বসে থাকে সেউ মধু ক্ষণটির জন্যে।
আমাদের প্রত্যাশা কবি জীবনানন্দ দাসের স্মৃতি সংরক্ষণার্থে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো একযোগে কাজ করুক। একত্রিত হোক আমাদের সংহতি। তাই জীবনানন্দ আলয় ‘সর্বানন্দ ভবন’কে সরকার অধিগ্রহণ করে বর্তমান সত্তাধিকারীকে পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করুক এটাই আমাদের কামনা।
[লেখাটি বরিশাল থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা ‘আনন্দলিখন’ এর ৮ম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।]
আমাদের বরিশাল ডটকম -এ প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
(মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর একান্তই নিজস্ব। amaderbarisal.com-এর সম্পাদকীয় অবস্থানের সঙ্গে এসব অভিমতের মিল আছেই এমন হবার কোনো কারণ নেই। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে amaderbarisal.com কর্তৃপক্ষ আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না।)